বন্ধুত্বে,ব্যক্তিত্বে, মানবিকতায় ড. মোঃ মোজাম্মেল হক খানকে যেমন দেখেছি

বন্ধুত্বে,ব্যক্তিত্বে, মানবিকতায় ড. মোঃ মোজাম্মেল হক খানকে যেমন দেখেছি

বন্ধুত্বে,ব্যক্তিত্বে, মানবিকতায় ড. মোঃ মোজাম্মেল হক খানকে যেমন দেখেছি

মঈনুদ্দিন মানু

 আজ থেকে তেতাল্লিশ/চুয়াল্লিশ  বছর আগের কথা।তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৮-৭৯ সেশনে  ভর্তি হয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে ডাবলিং সিট পেলাম শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল টিনশেড বর্ধিত ভবনের আট নম্বর কক্ষে।প্রথম দিকেই অন্যান্যদের সাথে পরিচয়ের সূত্রে তিন নম্বর কক্ষের মোজাম্মেল হক খান এর সাথে আমার পরিচয় হলে অনায়াস বন্ধন-বন্ধুত্বে জড়িয়ে গেলাম দু'জনে। মোজাম্মেল এর ডাক নাম সেলিম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই নামটি আমাদের কাছে ছিলো খোদাই করা নাম।চাকুরি জীবনের কর্মবলয়ে  মোজাম্মেল নামটি পরিচিতি ব্যাপ্তি  লাভ করলেও সেলিম নামটি শুধু অতি নিকটজনের মধ্যেই থেকে যায়।ফলে আমরা মোজাম্মেল কে দেখতে পাই তার অফিশিয়াল আর একাডেমিক নামে।

লম্বা টিনশেডের দক্ষিণ দিক হতে ক্রমানুসারে তিন নম্বর কক্ষটি ছিলো ওর।হাউজ টিউটর কিংবা রিডিং রুমে যেতে আসতে তার চোখাচোখি হতাম হরহামেশা।সুতীক্ষ্ণ চাহনি, স্নিগ্ধ চেহারা,মৃদুমাখা হাসি,পলকে স্মিত যাদু,পরিচ্ছদে সৌন্দর্যের ঝলক। তার পছন্দের জায়গাগুলোত সে সীমানা পরিবৃত। বন্ধু নির্বাচনেও সে আভিজাত্যপূর্ণ সীমানাবলয় দ্বারা পরিবৃত্ত । হল সীমানায় আমাদের চলাচল ইয়ারমেট হিসেবে হলেও তার সাবজেক্ট সমাজ কল্যাণ আর আমার বাংলা ভাষা ও সাহিত্য।যার কারণে বন্ধুদের কোন কোন  জায়গায় তার পরিচিত জনেরাও আমার বন্ধু। আহাদ,মুজিব আমার রুমমেইট বন্ধু হলেও তারাও তার সাবজেক্টের সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অবশ্যি মজিবুর রহমান হাওলাদার প্রথম দিকে মোজাম্মেল এরও রুমমেইট ছিলো। মোঃ মুজিবুর রহমান হাওলাদার সরকারের সাবেক সচিব ও নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান আর আহাদ উল্যাহ সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরের এডিশনাল ডাইরেক্টর।

 হল জীবনে মোজাম্মেল আমার রুমপ্রতিবেশী হলেও সে ছিলো দীপ্তময় স্বউজ্জল পৌরুষ। চলনে বলনে তার ছিলো ব্যক্তিত্বপূর্ণ জৌলুস। সত্য সুন্দর ছিলো তার চরিত্রের অন্য ভূষণ। সৌন্দর্য ছিলো তার লালিত্য ভুবন।মফস্বলের শৈশবআবরণে কৈশোরের মোজাম্মেল যেন আরো পরিণত আরো কোমল আরো সমুজ্জ্বল।

 তার ভেতর আশৈশবের লালিত্য বোধন দেখতে পেলাম।আমার কাছে কৈশোরপরিণত মোজাম্মেল এর ভেতর যে স্নেহ,ভালোবাসা,মমত্ব,সততা,নায়পরায়ণতা,অধ্যবসায়,ধৈর্য সহিষ্ণুতা,শিষ্ঠাচার ইত্যাদি মানবিক মূল্যবোধের সুকুমার কোমল বৃত্তিগুলোর বহিঃপ্রকাশ দেখেছিলাম তা যেন উপ্ত হয়েছিলো তার জন্মস্থান  মাদারীপুরের পাঁচখোলায়।

 মাদারীপুর সদর উপজেলার পাঁচখোলা ইউনিয়নের পাঁচখোলা গ্রামের সম্ভ্রম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম তার।বাবা আব্দুল কুদ্দুস খান আর মা ওয়াজেদা বেগমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি বড়ো।

মোজাম্মেল এর কাছে জীবনই বড়ো শিক্ষক। জীবন পরিক্রমায় সৌন্দর্যমেধা যেমন বিকশিত হয় তেমনি অসহিষ্ণু,অসৌজন্য,অসন্দিগ্ধ অসৌন্দর্যও পরম্পরায় বিবেকপ্রসূত হয়। সে ক্ষেত্রে মোজাম্মেল হক খান বিবেক প্রসূত,আজন্ম বিকাশমান সৌন্দর্যের পূজারি।ফলে বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনা থেকেই তার গুনমুগ্ধ হয়ে আছি আমি।

 বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে এসে একসময় জীবন সংগ্রামের প্রয়োজনে ছিটকে গেলাম আমরা।

মোজাম্মেল অনার্স পাশ করেই ৮২' র বিসিএস এর চাকুরি পেলো।

অত্যন্ত মেধাবী, চৌকস, দৃঢ়চেতা সে। অসামান্য মনোবল তার চরিত্রে স্হিত,গ্রথিত। বিদ্যা এবং বুদ্ধিতে জ্ঞানকে ধারণ করে সে পথ চলে।মেধার প্রাবল্যে তার স্ফূরণ ঐশ্বর্যের সীমানায় সহজে অতিক্রম্য।

 আমি চাকরি পেলাম ব্যাংকে।দীর্ঘসময় বন্ধন-বন্ধুত্বের ছায়া  কালো মেঘে আবৃত থাকলেও প্রায় এক দশক পর একদিন মন্ত্রণালয়ে তার সাথে আমার দেখা হলে জোছনাভো মায়াবী চেহারার মোজাম্মেল এর সাথে আমার পুনঃযোগাযোগ স্হাপন হলো।মোজাম্মেল এর সাথে দীর্ঘদিনের বিচ্ছন্নতা এতদিনের ভাটায় যেন জোয়ার এলো।সম্পর্কের ছেদ এ যেন নতুন করে টান পড়লো।

এখন মাঝে মধ্যেই কথা হয় মোজাম্মেল এর সাথে।মোজাম্মেলকে দেখতে থাকি আরো বড়ো পরিসরে, বড়ো গন্ডিতে।তার চেতনায় দেখতে পাই সৃষ্টির উল্লাস।নবদিগন্তে অপ্রতিরোধ্য অজেয়কে জয় করার প্রবল তেজদীপ্ত বাসনা তার।চলনে স্হির, বলনে মেধাদীপ্ত প্রাজ্ঞ সে।

কঠিন তার কাছে সহজ এক কর্মচাঞ্চল্য কর্মসাধনা।তার ভেতর দেখতে পাই জীবন সাধনার ভিন্ন ব্রতী। বিশ্ববিদ্যালয়ের চেতনাদীপ্ত মোজাম্মেল এবারে জীবনাকাঙ্ক্ষী সত্য সৌন্দর্যের উপলব্ধিতে গড়া এক নতুন মানুষ। উঁচু পরিসরে নিজেকে তুলে ধরার মাধ্যমে সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়বদ্ধতা তাকে অবিচল ও নিষ্ঠাবান করেছে প্রতিমুহূর্তে। তাই তো সকলের প্রতি  সহনশীল আচরণে তার অভ্যস্হতা গড়ে ওঠে পদ-পদবীর সিঁড়ির ধারাবাহিকতায়। বৈরী পরিবেশে অনভ্যস্হ মোজাম্মেল কখনো নিজেকে অসহায় ভাবেনি।বরঞ্চ পরিস্থিতিকে সামলে,ধৈর্যকে সাথী করে সামনে চলাই ছিলো তার কৌশলী মনোভাব।

 কষ্ট- মনোবেদনা তাকে স্পর্শ করলেও বন্ধুবৈঠকে তার সংস্পর্শে কখনো মনেই হয়না-সরকারের ছয়টি মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েও তার অহমিকা কিংবা আত্মঅহংকারবোধ বন্ধুদের কিংবা স্বজনদের ব্যাথিত করেছে।বরং আত্মঅহংকারের জায়গায় আমাদের তৃপ্তি আকাশপরিমান।আর এগুলো প্রতিভাত,সম্ভব হয়েছে সর্বক্ষেত্রে তার মানবিক আর সংবেদনশীল সহজসরল আচরণে।

শৈশব-কৈশোর-যৌবন এমনকি পরিণত বয়সেও যারা তার সান্নিধ্য পেয়েছে,সংস্পর্শ পেয়েছে সেখানেও দেখেছি মোজাম্মেল তাদের প্রতি সামাজিক দায়বদ্ধতায় আচরণগত দিক দিয়ে কত সহিষ্ণু, কত উদার,কত নমনীয়,কত হৃদয়বান,কত বোধবিবেচ্য ।

 ব্যাংকের চাকুরিতে থাকা অবস্হায় মোজাম্মেল এর স্কাউটিং কার্যক্রমসহ অন্যান্য সামাজিক সংগঠনে তার সম্পৃক্ততা আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রেরণায় দেয়।

 সেই ১৯৭৬/৭৭ সালে নটরডেম কলেজে পড়ার সময়  বিএনসিসি করা,সোহরাওয়ার্দী ময়দানে রাষ্ট্রপতিকে সালাম দেয়ার কথাও এসময় আমার মনে পড়ে যায়।ফলে স্কাউটিং কার্যক্রমে নিজেকে সম্পৃক্ত অনুসন্ধিৎসায় কালবিলম্ব না করে আমি ৬.১০.১২ খ্রিস্টাব্দে রোভার লিডার ওরিয়েন্টেশন কোর্স এবং ৩১.১২.১২ খ্রিস্টাব্দে রোভার স্কাউট ইউনিট লিডার বেসিক কোর্স সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করি।

অবশ্যি এর পূর্বেই আমি বাংলাদেশ স্কাউটস এর ওপেন স্কাউট গ্রুপ এর 'আমরা স্কাউট গ্রুপ'এর সহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্বরত থাকি- যার সভাপতি আমাদের ড. মোঃ মোজাম্মেল হক খান , প্রধান জাতীয় কমিশনার, বাংলাদেশ স্কাউটস ও মাননীয় কমিশনার দুদক।

বর্তমান আমি বাংলাদেশ স্কাউটস এর জাতীয় উপকমিশনার হিসেবে স্কাউট কার্যক্রমে তারই সরাসরি অধিনস্ত সহকর্মী হিসেবে তাকে আরও কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাই।

 মোজাম্মেলকে দেখি নতুন রূপে, নতুন অবয়বে,নতুন বর্ণে,নতুন ছন্দে। বাংলাদেশ স্কাউটস এর প্রধান কান্ডারী অর্থাৎ তাকে পাই বাংলাদেশ স্কাউটস এর প্রধান জাতীয় কমিশনার হিসেবে। শুধু তাই নয় তাকে পাই বাংলাদেশ স্কাউট আন্দোলনের  তিন মেয়াদের সফল প্রধান  নেতৃত্বদানকারী হিসেবে।, ইতিমধ্যে বাংলাদেশের স্কাউট অঙ্গন ছাড়িয়ে তার দিপ্তীময় ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের সকল স্কাউট অঙ্গনে।পুরস্কার পুরস্কারে সয়লাব হয় তার নিজ ভুবন।গর্বে গর্বিত হয় বাংলাদেশ,বাংলাদেশ স্কাউটস।

 একজন প্রথিতযশা সরকারি আমলা,একজন সফল স্কাউটার ড. মোজাম্মেল হক খান এর রয়েছে এর বাইরেও অন্য ভুবন অন্য জগৎ। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা, শিক্ষা সম্প্রসারণ,ধর্মীয় চেতনায় উদারনৈতিক  মানবিকতা,মানবীয় কার্যক্রমের  আওতায় সে একক প্রচেষ্টায় মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলাস্হিত নিজ জন্মস্হান নিজগ্রামে গড়ে তুলেছেন:- ওয়াজেদা কুদ্দুস খান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন প্রবীণ নিবাস,নার্সিং ইন্সটিটিউট, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র,এতিমখানা, স্কুল, কলেজ,আধুনিক অডিটোরিয়াম, মসজিদ, মাদ্রাসা,হাসপাতাল, টিএমএসএসের কেন্দ্র, কমিউনিটি পুলিশিং কেন্দ্র, পল্লীবিদ্যুতের অফিসসহ নানা ধরনের সরকারি-বেসরকারি স্হাপনা ও ক্যাম্পাস।

 নির্মিত/ নির্মিতব্য নয়নাভিরাম সুউচ্চ ভবনসমূহে আধুনিক শিক্ষা সম্প্রসারণ,সামাজিক উন্নয়ন ও মানবিক কার্যক্রম পাঁচখোলা তথা অত্র অঞ্চলে এখন হাতের নাগালে।

দৃষ্টিনন্দিত এমন ক্যাম্পাস যেন মাদারীপুর শহরের মধ্যে আরেক শহর। শিক্ষান্নোয়নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ড. মোঃ মোজাম্মেল হক খান কলেজ,ড. মোঃ মোজাম্মেল হক খান অডিটোরিয়াম, পাকা রাস্তা, ছাত্রাবাসসহ অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। আমার কাছে মনে হয়েছে- মোজাম্মেল স্বপ্ন দেখেন তার চারপাশকে ঘিরে, মানুষকে ঘিরে, সমাজকে ঘিরে, দেশকে ঘিরে। নিজেকে বিলিয়েও দেন সাধ্যসীমানার সর্বোচ্চ ব্যবহারে*।

 স্বপ্ন তার কর্মপ্রবাহের চালিকাশক্তি হলেও অদম্য ইচ্ছেই তার নিয়ন্তা।খোলা দিগন্তে তার বিচরণ হলেও মানুষ মানবিকতার উন্নয়নচেতনাই তার প্রচ্ছন্ন শক্তি - যা তাকে শুধু আবেগী করে না সত্য সুন্দরকে পথও দেখায়।সৃষ্টির উল্লাস আছে বলেই কর্মে সে উদ্যোগে উদ্যমী৷

 ধৈর্য এবং আচরণে তার সম্পর্কে আমার পূর্বাপর অভিজ্ঞতায় যতটুকুন তাকে দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, অবহেলায় নয়, অবজ্ঞায় নয় কিংবা দায়সারা কর্তব্য এড়ানোর জন্যেও নয় -সমস্যা জড়িতদের সে শুনেছে হৃদয় দিয়ে,মমত্ব দিয়ে,মানবিকতা দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে। তাইতো ড. মোঃ মোজাম্মেল হক খান সকলের মমত্বে, ভালবাসায় চিরঞ্জীব থাকবে অনাদিকাল অনন্তসময়।

লেখক: জাতীয় উপকমিশনার (মিডিয়া এন্ড পাবলিকেশন) বাংলাদেশ স্কাউটস ও

            সাবেক ডিজিএম, জনতা ব্যাংক লিমিটেড